নিজ্রস প্রতিনিধি সুজাতা দে: আজকের পৃথিবীতে জল সংকট এক ভয়াবহ বাস্তবতা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পানযোগ্য জলের চাহিদা বেড়েই চলেছে। একদিকে ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বহু অঞ্চল আজও নিরাপদ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের আইআইটি মাদ্রাজ এবং একটি স্টার্টআপ সংস্থা ‘তীর্থ’ মিলে তৈরি করেছে এক অভিনব জল সঞ্চালন যন্ত্র – যার নাম ‘নিরো’।
‘নিরো’ কীভাবে কাজ করে?
‘নিরো’ এমন এক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্র, যা কৃত্রিমভাবে বাতাস থেকে জল আহরণ করতে পারে। যন্ত্রটি সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে পরিবেশের আর্দ্রতা সংগ্রহ করে এবং তা থেকে দিনে ৫ থেকে ১০ লিটার পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানীয় জল তৈরি করতে সক্ষম। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই পুরো প্রক্রিয়ায় একটিও ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় না। শুধুমাত্র সূর্যের আলো আর বাতাসই এর জ্বালানি।
এই প্রযুক্তির পেছনে মূল ধারণাটি হলো “Atmospheric Water Generation (AWG)”, যা বাতাসে বিদ্যমান আর্দ্রতাকে শীতল করে তরল জলে রূপান্তর করে। নিরো-র সূর্যচালিত যন্ত্রাংশ দিনভর শক্তি সংগ্রহ করে এবং ভেতরে থাকা প্রযুক্তি নির্দিষ্ট পর্যায়ে ঠান্ডা করে জল সঞ্চয় করে।
কেন এই উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ?
ভারতের বহু প্রত্যন্ত গ্রাম ও দুর্গম অঞ্চলে আজও পানীয় জলের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। শহরের বাইরের এলাকায়, বিশেষ করে মরুভূমি, পাহাড়ি গ্রাম বা দ্বীপ অঞ্চলে পরিবহন করে জল পৌঁছানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। ঠিক এই জায়গাতেই ‘নিরো’ এক আশার আলো।
এছাড়াও, ‘নিরো’ যেহেতু সৌরশক্তি নির্ভর, তাই এটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। এতে নেই কোনো কার্বন নিঃসরণ বা বৈদ্যুতিক খরচ। জল উৎপাদনের খরচ প্রায় শূন্য এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি একটি লাভজনক ও কার্যকর সমাধান হয়ে উঠতে পারে।
বাস্তব প্রয়োগ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
‘নিরো’ ইতিমধ্যে কয়েকটি পরীক্ষামূলক এলাকায় ব্যবহার করে দেখা হয়েছে এবং ফলাফল যথেষ্ট আশাজনক। এটি বিশেষত স্কুল, আর্মি ক্যাম্প, দুর্গম গ্রাম, ছোট হাসপাতাল বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জরুরি জল সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তীর্থ এবং আইআইটি মাদ্রাজের যৌথ উদ্যোগ ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করে বড় পরিসরে ছড়িয়ে দিতে চায়। উৎপাদন খরচ কমিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনার লক্ষ্যও রয়েছে তাদের।
‘নিরো’ শুধুমাত্র একটি যন্ত্র নয়, এটি একটি বিপ্লব। এটি দেখিয়ে দিল, প্রযুক্তি যদি মানুষের প্রয়োজনকে সামনে রেখে তৈরি হয়, তাহলে তা জীবন বদলে দিতে পারে। সৌরশক্তি ও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে জল উৎপাদনের এই উপায় আমাদের শেখায়, ভবিষ্যতের টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের স্মার্ট ব্যবহারে। ভারতের জল সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে এই উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল।