Sunday, July 20, 2025
Homeখবরআমার বাবা ও দাদু

আমার বাবা ও দাদু

আমার বাবা অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেব কুমার ঘোষ, দাদু দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ সহ সকল বিপলবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে স্মরণ করছি সেই সব নাম না জানা বিপ্লবী, যাদের আত্নত্যাগে আজকের স্বাধীন ভারত গড়ে উঠেছে। আমরা যেনো ভুলে না যাই এই মহাত্নাদের যাদের আত্নত্যাগে আমরা পেয়েছি এই স্বদেশ ভূমিকে।

আমার বাবা ও দাদু দুজনেই তদান্তীনতন অখন্ড ভারতের বাংলাদেশের বরিশালে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯০৩ সালে কলকাতায় বিপ্লবী দল অনুশীলন দল গঠনের পর পরই ঢাকায় ১৯০৫ সালে অনুশীলন দল গঠিত হয়। বরিশালে এই অনুশীলন দল প্রতিষ্ঠা করেন আমার দাদু দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ ।এসময় তিনি অশ্বিনী কুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত লিটল ব্রাদার্স অব দি পুওর নামে স্বদেশ কল্যান মূলক সমিতিতে যোগ দিয়ে দরিদ্রদের সেবায় আত্ন নিয়োগ করেন।

১৯০৬ সালের ১৫ ও ১৬ এপ্রিল , মহাত্না অশ্বিনী কুমার দত্তের আহবানে,কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বসে বরিশাসে। ব্যারিষ্টার আবদুর রসুল সেই সভার সভাপতি হিসেবে বরিশালে আসেন। দেশ নায়ক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সহ নেতৃবৃন্দ বরিশালে আগমন করেন। বৃটিশ সরকার এক পর্যায়ে এই অধিবেশন কে বেআইনী ঘোষণা করে লাঠিচার্জ করে বহু মানুষ আহত হয়। একজন স্কুল ছাত্র হিসেবে সে সময়ে আমার দাদু এই আন্দোলনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন।

১৯০৭ সালে থেকেই আমার দাদু বরিশালে অনুশীলন দলের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিপ্লবী দলের হয়ে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পত্র আদান প্রদান করা, ব্যায়ামাগার স্থাপন করে সেখানে শরীর ও মনে শক্তিশালী তরুনদের অংশগ্রহনের উদ্যোগ নেয়া সহ ও সামাজিক স্বদেশ প্রেরণা মূলক কর্মকান্ডে ঝাপিয়ে পড়েন তিনি। ব্রজমোহন স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়েই তিনি বৃটিশ পুলিশের নজরে পড়েন। তাকে রাজনিতক সংশ্রব বাদ দিয়ে দিয়ে স্কুলে পড়তে হবে, মুচলেকা দিয়ে –পুলিশ কতৃপক্ষের এই ঘোষণায় তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। তাকে ভারতবর্ষের সকল স্কুলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়া হয়। এই সময় তিনি কিছুকাল বরিশাল হিতৈষী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯১২ সালে বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষের প্রথম ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে যা ‘ বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা নামে বহুল প্রচারিত । এই মামলায় ৪৪ জনের মধ্যে বৃটিশ সরকার ৩৭ জনকে গ্রেফতার করে। এই মামলায় প্রায় ২ বছর সাজা ভোগ করেন আমার দাদু।

১৯২৫ সালে তিনি আবার বরিশালে ফিরে এসে নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সূর্যকান্ত ব্যায়াম বিদ্যালয়’ যা বর্তমানে কাউনিয়া ক্লাব নামে পরিচিত।

১৯২৬ সালে বরিশাল কৃষি প্রদর্শনীর নামে জুয়া খেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রেফতার হন দেবেন্দ্রনাথ।

১৯২৯ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন তিনি। ১৯৩০ সালে বরিশালে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নায়ক মাস্টার দা সূর্য সেন ও তাঁর সঙ্গী বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তিনি আবারো বরিশালে গ্রেপ্তার হন। ১৯৩১ সালে বারাসাত জেল থেকে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার জেলে স্থানান্তর করে তাঁকে ভিলেজ ডেটিনিউ হিসেবে আটক রাখা হয়। এর পর ছাড়া পেয়ে বাঁকুড়া থেকে তিনি বরিশালে ফিরে আসতেই আবার ১৯৩৩ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে দেউলী জেলে। জেলে জেলে ঘুরতে থাকে তার জীবনচক্র। ১৯৩৮ সালে জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে এবং তা বিলোপ হবার লক্ষ্যে ফ্লাউড কমিশনে সাক্ষ্য দেন দেবেন্দ্রনাথ।

১৯৪০ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের আগমন কর্মসূচিকে সফল করার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি। এই কর্মসূচিতে তাঁর সহযোগী ছিলেন শহীদ হীরালাল দাশগুপ্ত। এরপর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে ছয় বছর কারাবন্দী ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান এবং সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এর আগে অবশ্য তিনি আরএসপির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।১৯৪৮ সালে ‘যুব সংঘ’ গঠন করে একই সঙ্গে দুর্ভিক্ষ মোচন ও কালোবাজারী দমনে মাঠে নামেন তিনি। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকা রাখায় তাঁকে পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তাবন্দীর নামে আটক করে জেলে পাঠায়। ১৯৫৩ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশিক সভার সদস্য হন

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেবেন্দ্রনাথকে দেশরক্ষা আইনে বন্দী করা হয়। এক বছর পরে মুক্তি পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ছয় দফা বাস্তবায়নের আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দাদুর মতো আমার বাবাও বুটিশ সরকারের সময় ১০ বছর ও পাকিস্তানের সময় অন্তত পাচ বছর জেল জীবন ভোগ করেন। আমার বাবা স্বদেশী ব্যায়ামাগারে প্রশিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন ভারত সেবাশ্রমের বিভিন্ন ইউনিটে (বিহার) কাজ করেন। লাঠি খেলায় প্রশিক্ষক হিসেবে সুনাম থাকায় তিনি ‘ লাঠিবাবু ‘ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান আমলে জেলখানায় তাকে খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়ায় তাকে চোখের দৃষ্টি শক্তি হারাতে হয়। পাকিস্তান আমলে বাংলাভাষা আন্দোলনে আমার বাবা ও দাদু দুই জনেই যোগ দেন। শুধু আমার বাবা ও দাদু নয় আমার ঠাকুরমা বৃটিশ সরকারের বহু নির্যাতন ভোগ করেন। আমার কাকারও বিভিন্ন সময় বৃটিশ সরকারের বহু নির্যাতন ভোগ করেন। আমার দাদু প্রায় ২৭ বছর জেল ও আমার বাবা ১৫ বছর জেল খাটেন। সারা জীবনই তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন দেশের মানুষের কল্যানে। যতোদিন ভারতবর্ষ থাকবে, ভারতের সোনার এই ছেলেদের অবদান ততদিন থাকবে সোনার অক্ষরে-আমরা যেনো ভুলে না যাই তাদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments