
প্রথম যখন লন্ডন থেকে ফেরা একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ কিডনির চিকিৎসক, পায়ে হেঁটে মানুষকে উত্তর কলকাতার গলি, বাগবাজার, সুতানুটি, গঙ্গার ঘাট বা কুমারটুলীর মন্দির চেনাতে নিয়ে যান মানুষজনকে, তখন আত্মীয় থেকে বন্ধু সবাই অবাক হয়েছিলো । কিন্তু লক্ষ্যে অটল ডাঃ পার্থসারথী মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ডাক্তারি তার নিজের জায়গায় থাকুক, কিন্তু প্রিয় শহর তিলোত্তমার জন্য যদি কেউ সময় না দেয়, কেউ যদি তার অসাধারণ ঐতিহ্য, ইতিহাস বা ‘ হেরিটেজ ‘ সংরক্ষণ চেয়ে আওয়াজ না তোলে, পরবর্তী প্রজন্মকে এনে নিজের শহরকে ভালোবাসতে না শেখায় তাহলে এই শহর ভগ্নস্তূপে পরিনত হবে, আর বাঙালি জাতি হারাবে তার জাতিগৌরবের শিকড় । শেষ হয়ে যাবে আমাদের বাঙালিয়ানা ।
বাগবাজারের এক বিখ্যাত বনেদি বংশের নাতি হয়ে. তার জন্ম । আগেই তৈরি করেছিলেন ‘বেঙ্গল ফোরাম ফর ইন্টেলেক্ট আ্যন্ড কালচার ‘ , বিশ্বের সব দেশের বাঙালির অনলাইন ফোরাম বা সাংস্কৃতিক মহামঞ্চ । একসঙ্গে এনেছিলেন প্রতিটি বনেদী বাড়ির পুজো পরিবার ও বাঙালি মহাপুরুষদের বংশধরদের । মানুষকে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামে, জেলার অনেক শতাব্দীর পুরোনো অথচ অধুনা অবহেলিত পুজোগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে । চার বছর আগে মহামারী পর ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু করেছিলেন ‘ শ্রেষ্ঠ বনেদী বাড়ির পুজো শারদ সম্মান – হল অফ ফেম ‘ । ইউনেস্কোর কর্তাদের নিজে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন পারিবারিক ঐতিহ্যের বনেদী পুজোগুলো ঠিক কোথায় থিমের বারোয়ারী পুজোর থেকে আলাদা । আর্কাইভ তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত বাঙালিদের ভিটের, যা অধুনা অবহেলিত । মানুষকে বুঝিয়েছিলেন’ ভালো থাকুন, বাঙালি থাকুন ‘, বলেছিলেন হিন্দুবাদী, মার্কসবাদী বা নারীবাদী তো অনেক দেখলাম, এবার একটু নাহয় ‘ বাঙালিবাদী ‘ হওয়া যাক ।
তা এহেন ডাঃ মুখার্জি কুমারটুলী বাগবাজারকে বেছে নিলেন কেন ? কারণ তাঁর ভাষায় ‘ এটা আমাদের আভিজাত্যের কেন্দ্রবিন্দু আর বাঙালির ইতিহাসের আঁতুড়ঘর ‘ । মহিলা মৃৎশিল্পি থেকে রসগোল্লা, সুতানুটির ঘাট থেকে যাত্রাপালা, প্রথম বারোয়ারী থেকে থিয়েটার, রেডিও সারাই এর শেষ দোকান থেকে চপ কাটলেট, মদনমোহন থেকে আদি ঢাকেশ্বরী, আর সমস্ত মহাপুরুষের পদধূলিধন্য এই মাটি , এ যেন কলকাতার মধ্যেই একটা গোটা পৃথিবী ! বারেবারে তিনি দেশ বিদেশের মানুষকে নিয়ে ফিরে এসেছেন এই গলিতে, ‘আসল’ কলকাতা দেখাতে । মিডিয়ার বহু সাক্ষাৎকারে ইউনেস্কোর কাছে দাবি করেছেন ‘ বাগবাজার কুমারটুলী সুতানুটি ‘ অঞ্চলের জন্য আলাদা ‘ ইউনেস্কো হেরিটেজ জোন ‘ স্ট্যাটাস ।
কোনোদিন হয়তো ২০২৫ সালে, নয়াদিল্লি থেকে সম্মানিত ‘ সেরা বাঙালি ‘ ডাঃ পার্থসারথী মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্ন সফল হবে । তার আগে অক্ষয় হয়ে থাক নানা প্রজন্মের , বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা জনা চল্লিশ বাঙালি ছেলেমেয়ের মধ্যে এই শহরের জন্য নতুন করে জাগা ভালোবাসা । মিত্র ক্যাফের চপ, কে সি দাশের রসগোল্লার সঙ্গে মিশে থাকা গঙ্গার ঘাটে এতগুলো বাঙালির মুখের হাসি । বাঙালির এই দুর্দিনেও । বিলেতফেরত এক বাঙালিপাগল ডাক্তারবাবুর সৌজন্যে ।

